অবৈধ গ্যাস সংযোগ থেকে অগ্নিকাণ্ড, বিস্ফোরণ, প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটছে। আরও বড় ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কা থাকলেও গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর পক্ষে সব লাইন পুরোপুরি অপসারণ কঠিনই। কারণ অবৈধ গ্যাস সংযোগের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে রাজনৈতিক নেতা, স্থানীয় প্রভাবশালী সুবিধাভোগী শ্রেণি এবং গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর স্থানীয় অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী। ফলে বছরের পর বছর কেবল অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মুখে নানা হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে। তার পরও কমছে না অবৈধ গ্যাস সংযোগ, বরং তা বেড়েই চলেছে। এর ফলে বাড়ছে নানা দুর্ঘটনার ঝুঁকি।
বিগত সংসদ নির্বাচনের সময় রাজধানীর আশপাশে কয়েক সংসদ সদস্য প্রার্থী অবৈধ গ্যাস সংযোগকে নির্বাচনী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। প্রকাশ্যে জনসভায় ঘোষণা দিয়েছেনÑ ভোট দিলে এলাকায় সবাইকে গ্যাস সংযোগের সুযোগ করে দেবেন। ওই সময় আইনানুগ গ্যাস সংযোগ বন্ধ ছিল। এখনো আবাসিকে গ্যাস সংযোগের অনুমতি নেই।
এদিকে অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে কয়েক বছরে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সরকারের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছে। সেসব প্রতিবেদনে তারা উল্লেখ করেছে অবৈধ গ্যাস সংযোগের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী এবং তিতাসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত থাকার কথা। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ও চায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ অপসারণ। জ্বালানি বিভাগের এক অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে কয়েক বছর আগে কমিটিও করা হয়; কিন্তু অবৈধ গ্যাস সংযোগ অপসারণ
হয়নি। বেশ কয়েকবার মন্ত্রণালয় থেকে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোকে আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ অপসারণে; কিন্তু আলটিমেটাম আর চিঠি চালাচালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
বছরের পর পর কেন অবৈধ গ্যাস সংযোগ অপসারণ করা যাচ্ছে নাÑ জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ আমাদের সময়কে বলেন, অবৈধ গ্যাস সংযোগ অপসারণে আমরা তৎপর। অনেক অবৈধ গ্যাস সংযোগ বন্ধ হয়েছে। তবে কোথাও কোথাও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের আপত্তি আছে। তাদের লোকজন বাধা দেয়। এবার যারা বাধা দেবে তাদের সঙ্গে কথা বলব। অবৈধ গ্যাস সংযোগ উচ্ছেদ করা হবে।
এদিকে নারায়ণগঞ্জের মসজিদে গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সাড়া ফেলেছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি ঘটনা দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় আজ জরুরি এক সভা ডেকেছে। আজকের বৈঠকটি হবে মূলত অবৈধ গ্যাস সংযোগ অপারসণ সংক্রান্ত।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি অবৈধ গ্যাস সংযোগ তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে (তিতাস)। এসব অবৈধ গ্যাস সংযোগকে পুঁজি করে তিতাসের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা লাভবান হচ্ছেন। বৈধ হওয়ার সুযোগ না থাকায় অবৈধ ব্যবহারকারীদের নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দিয়ে মাসে মাসে বিল আদায় করে নিজেদের পকেট ভারী করছেন কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী।
এদিকে অবৈধ গ্যাস সংযোগগুলো বৈধতা দিতে সংসদ সদস্যরা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ-সোনারগাঁও এলাকার সংসদ সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগে চিঠি দিয়েছেন যেসব অবৈধ গ্যাস সংযোগ ব্যবহারকারী আছেন, তাদের নিয়মের আওতায় এনে বৈধতা দিতে। শুধু লিয়াকত হোসেন খোকা নয়, এমন অনেক এলাকার সংসদ সদস্যই মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন অবৈধ গ্রাহকদের বৈধ করে নিতে। তবে এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস কোম্পানির একাধিক বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তার অভিযোগ কাগজ-কলমে হয়তো অবৈধ গ্যাস সংযোগ ব্যবহারকারীদের বৈধতা দেওয়া যাবে। তবে বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে কারিগরি জটিলতা রয়েছে। তাদের অভিমত, গত ৮/১০ বছরে যারা অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়েছে তাদের অধিকাংশ নিম্নমানের পাইপ এবং নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করে এসব সংযোগ নিয়েছে। মূল পাইপলাইন থেকে গ্যাসের প্রেশার বাড়লেই এসব ব্যবহারকারীর বাড়িঘরে আগুন লেগে যাবে। অথবা নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে পাইপলাইন টানার কারণে খুব সহজেই এসব উপকরণ ক্ষয়ে ছিদ্র হয়ে যাবে। ফলে গ্যাস লিকেজ তৈরি হবে এবং দুর্ঘটনা ঘটবে। তাদের অভিমত, বৈধতা দেওয়া হলেও প্রতিটি সংযোগ ধরে তিতাস বা যে কোনো বিতরণ কোম্পানির অনুমোদিত পাইপ বা উপকরণ ব্যবহার করে আবার নতুন করে সংযোগ দিতে হবে।
বিষয়টি নিয়ে তিতাসের পাইপলাইন শাখার মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. আব্দুল ওহাবের সঙ্গে কথা বললে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, অদূর ভবিষ্যতে আরও বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছি। তিনি বলেন, সত্যিকার অর্থে নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এমনভাবে গ্যাস নেটওয়ার্ক বা পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে, অগ্নিকা- বা বিস্ফোরণ আরও ঘটতে পারে। সব জায়গায় অবৈধ গ্যাস পাইপলাইনের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী বা একটা সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি হয়েছে। ফলে তিতাস কর্তৃপক্ষ আন্তরিকতার সঙ্গে চাইলেও নানা প্রভাবে সব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারছে না।
প্রসঙ্গত, প্রকৌশলী মো. আব্দুল ওহাব নারায়ণগঞ্জের মসজিদে দুর্ঘটনা তদন্তে তিতাসের গঠিত কমিটির প্রধান। নারায়ণগঞ্জের দুর্ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তদন্ত করব। তিনি বলেন, আমরা জানতে চেষ্টা করছি মসজিদের নিচে গ্যাসের পাইপলাইন কীভাবে গেল। সেটা কি আগের লাইন ছিল, নাকি মসজিদটি পাইপলাইনের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে। সেই গ্যাস লাইন বৈধ না অবৈধ। তিনি বলেন, আমাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করতে কয়েকদিন লাগবে।
অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আলী মো. আল মামুন আমাদের সময়কে বলেন, তিতাস অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিষয়ে সব সময়ই অভিযান পরিচালনা করে আসছে। তবে দুঃখের বিষয়, একদিকে সংযোগ অপসারণ করলে আরেকদিক দিয়ে সংযোগ দিয়ে দিচ্ছে দুর্নীতিবাজ লোকজন।
Leave a Reply